“আমার জমিতে এখন ধান হয় না, ধোঁয়া লাগে বেশি।”
এই কথাটা বলেন ধামরাইয়ের কালাম্পুর গ্রামের কৃষক আবদুল মান্নান, যিনি তাঁর আবাদি জমির অর্ধেকটাই হারিয়েছেন ইটভাটার ধোঁয়া আর জমি কাটার করাল থাবায়।
ঢাকার পাশের কৃষিপ্রধান উপজেলা ধামরাই এখন ধীরে ধীরে হারাচ্ছে তার প্রাকৃতিক উর্বরতা। শত শত বছরের কৃষিপরিবারেরা এখন দিশেহারা।
প্রতিদিন ইটভাটার কালো ধোঁয়া আর ভেকু দিয়ে কেটে নেওয়া মাটিতে নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার একর পাকা ধান ও সবজির খেত।
ইটভাটার কালো ধোঁয়া: ধান পুড়ছে চোখের সামনে
ধামরাইয়ে বর্তমানে অনুমোদিত ও অননুমোদিত মিলিয়ে প্রায় ১৫০টি ইটভাটা সক্রিয়ভাবে চলছে।
এদের অধিকাংশ গড়ে উঠেছে ফসলি জমির আশপাশে।
চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় রয়েছে:
• কার্বন মনোক্সাইড
• সালফার ডাই-অক্সাইড
• ভস্ম ও ভারী ধাতু কণিকা
ফলাফল:
• ধানের পাতায় ধোঁয়ার ছাই বসে পাতা শুকিয়ে যায়
• গাছের স্বাভাবিক সালোক-সংশ্লেষ ব্যাহত হয়
• ধানের শীষে ব্ল্যাক স্পট বা সাদা দাগ পড়ে
• ধান আগেভাগে ঝরে যায় বা কাঁচা অবস্থায় পেকে যায়
• একেক মৌসুমে ৩০-৪০% পর্যন্ত ফলন কমে যাচ্ছে
. ভেকু দিয়ে কৃষি জমির মাটি কাটা: ইটভাটার কাঁচামাল
শুধু ধোঁয়া নয়, ইটভাটা ব্যবসায়ীরা এখন ভেকু দিয়ে ফসলি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
এসব মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে।
এতে কী হচ্ছে:
• জমি একবার কাটা মানে চিরতরে অনাবাদি হয়ে যাওয়া
• ভূ-গর্ভস্থ স্তরের পরিবর্তন → পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে
• জমি নিচু হয়ে → পানি জমে চাষাবাদ ব্যাহত
• স্থানীয় পরিবেশের ইকোসিস্টেম ধ্বংস
👨🌾 স্থানীয় কৃষক রহিম শেখ বলেন:
“আগে যেখানে ধান হতো, এখন সেখানে ট্রাক ঢোকে মাটি নিতে। সকাল থেকে রাত — শুধু ভেকুর শব্দ আর ধোঁয়া।”
পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের হুমকি
শুধু কৃষি নয় —
ইটভাটার ধোঁয়ায় ধামরাইয়ের শিশু, বৃদ্ধ, রোগীরা ভুগছেন:
• শ্বাসকষ্ট
• হাঁপানি
• চর্মরোগ
• চোখ জ্বালা
বায়ুদূষণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর কয়েকটি ইটভাটাকে নোটিশ দিলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
আর্থসামাজিক বিপর্যয়
বিষয়প্রভাবচাষাবাদফলন কমে গেছে, কৃষক ঋণে ডুবেজমির দামকৃষি জমির দাম পড়ে যাচ্ছেখাদ্য নিরাপত্তা ধামরাইয়ের চাল, সবজি উৎপাদন হুমকিতেকৃষিজীবী পরিবারবিকল্প কাজের অভাবে দারিদ্র্য বেড়েছে
আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই
২০১৩ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে:
“আবাদি জমি কেটে ইটভাটা স্থাপন ও মাটি ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয়।”
কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, ভূমি অফিস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বে ধীর গতিতে, প্রভাবশালীদের মদত, এবং দালাল চক্রের দাপটের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আইন কার্যকর হচ্ছে না।
করণীয় সুপারিশ
🔹 অবৈধ ইটভাটা বন্ধে তৎপর অভিযান
🔹 সকল ফসলি জমি চিহ্নিত করে সরকারি সংরক্ষণ
🔹 ভুক্তভোগী কৃষকদের পুনর্বাসন ও ভর্তুকি
🔹 পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাসিক পর্যবেক্ষণ
🔹 স্থানীয় যুবসমাজ ও স্বেচ্ছাসেবীদের পরিবেশ সুরক্ষা কার্যক্রম।
“ধান জন্মে কৃষকের ঘামে, ধ্বংস হয় ধোঁয়ার কামে”
এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
ধামরাইয়ের কৃষিজমি যদি আজ না রক্ষা করা যায়, কাল পুরো বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
সময় এসেছে কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর।
ইটভাটা নয়, ধানখেত চাই। ধোঁয়া নয়, জীবন চাই।
📝 প্রতিবেদন: ধামরাই বার্তা ২৪